নিজস্ব প্রতিবেদক,
সুন্দরগঞ্জের সাংবাদিক সমাজে আবারও বিতর্কের ঝড় বইছে। ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় “সুন্দরগঞ্জ সম্মিলিত প্রেসক্লাব” নামে একটি নতুন সংগঠন। ঘোষণা করা হয়েছিল, তিন মাসের মধ্যেই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু সময়ের ঘূর্ণিপাকে ছয় মাস পার হয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে কথার খাতায়। বরং সংগঠনের নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও উদ্দেশ্য নিয়ে জেগেছে নানা প্রশ্ন।
এই প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক করা হয়েছে মোঃ নজরুল ইসলামকে। কিন্তু কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন এমন কিছু ব্যক্তি, যাদের মূল পরিচয় সাংবাদিকতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়েই বেশি পরিচিত। যেমন—বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির আমীর মোঃ শহিদুল ইসলাম মঞ্জু, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোঃ বাবুল আহমেদ, পৌর বিএনপি নেতা মোঃ ইব্রাহিম ভূঁইয়া (নিপল) এবং সাবেক পৌর মেয়র মোঃ নূরনবী প্রামানিক (সাজু)। এ ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে সাংবাদিক সংগঠন পরিচালনার ফলে প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে গভীর অনাস্থা ও অসন্তোষ।
বহু পেশাদার সংবাদকর্মী অভিযোগ করেছেন, যাঁরা নিয়মিত সংবাদপত্র, টিভি ও অনলাইন মাধ্যমে কাজ করছেন, তাঁদের এই কমিটিতে রাখা হয়নি। এমনকি, তাঁদের মতামত বা সম্মতি ছাড়াই এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে—এই সংগঠনের পেছনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও উদ্দেশ্যের ছায়া রয়েছে।
একজন প্রবীণ সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
সাংবাদিক সংগঠন গঠনে যদি রাজনৈতিক নেতারা আধিপত্য বিস্তার করেন, তাহলে আমাদের পেশাগত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা কোথায় থাকবে? সত্য প্রকাশের জায়গা তাহলে কার ইশারায় চলবে?”
আইন অনুযায়ীও বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট আইন, ১৯৭৩ এর ধারা ৫(১) বলছে—“গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট সংগঠনে সদস্যপদে ভর্তির ক্ষেত্রে পেশাগত স্বীকৃতি ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক।”
আর ধারা ৭(২) বলছে—“রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংগঠন গঠন সাংবাদিকতার নৈতিকতার পরিপন্থী।”
এই আইনি প্রেক্ষাপটে, সুন্দরগঞ্জে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত একটি সাংবাদিক সংগঠন গঠন করা যেমন নিয়মবিরুদ্ধ, তেমনি তা সাংবাদিকদের মর্যাদা ও দায়িত্বেরও পরিপন্থী।
এদিকে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়াও কম নয়। বাজার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত আলোচনার বিষয় এখন একটাই—প্রেসক্লাব আসলে কার? সাংবাদিকদের নাকি রাজনীতিকদের?
একজন দোকানদার মন্তব্য করেন, প্রেসক্লাব তো হওয়ার কথা সাংবাদিকদের, যারা জনগণের কথা বলে। কিন্তু এখানে মনে হয় নেতারাই সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছেন। তাহলে আর সাংবাদিকদের জায়গা কোথায়?”
আরও বিস্ময় জাগিয়েছে এই যে, ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। অথচ ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠিত করার কৌশলই যেন প্রয়োগ করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ উঠেছে অনেকের মুখে।
সুন্দরগঞ্জের সাংবাদিক সমাজে আজ চরম অনাস্থা, বিভক্তি এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাংবাদিকতা যেন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের একটি উপকরণ না হয়ে পড়ে, সেই লক্ষ্যে প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও প্রকৃত সাংবাদিকদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন।
প্রেসক্লাব হতে হবে পেশাদার সংবাদকর্মীদের জন্য মুক্ত ও নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম, না যে কেউ রাজনৈতিক পরিচয়ে এসে ‘সভাপতি’ সাজবে।
প্রশ্ন একটাই—সাংবাদিকতা কি থাকবে সাংবাদিকদের হাতে, নাকি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণেই চলবে সুন্দরগঞ্জের “সম্মিলিত প্রেসক্লাব”?